সবুজ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, প্রযুক্তি বিপ্লবের ছোঁয়াতে উপকূলের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। দুর্যোগ-দুর্ভোগে ফিনিক্স পাখির মতন জেগে ওঠতে শুরু করে উপকূলের কৃষক-জেলে-জনতা। এঁরা বিষন্নতা-ঝুঁকি-দুর্যোগ দু’পায়ে মাড়িয়ে রপ্তানি আয়ের চাকা ঘোরায়, জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে গতি আনে-স্বপ্ন দেখায় সমৃদ্ধি আগামীর। উপকূলের চিংড়ি, কাঁকড়া, সবজি, ফল বিশ্ববাজার থেকে ছিনিয়ে আনে গৌরব আর ডলার।
জলবায়ু পরিবর্তনের দানবীয় ঝুঁকিতে থাকা জোয়ার-ভাটার জনপদ আর মাঠ-ঘাটে এসেছে বৈচিত্র্যময় পরিবর্তন। বিষন্নতা আর সম্ভাবনা উপকূলীয় বাংলাদেশের কৃষি, জীবন ও জীবনযাপনকে চ্যালেঞ্জিং ও বৈচিত্র্যময় করেছে। এখানে নিত্য জোয়ার-ভাটার ছন্দে আন্দোলিত হয় স্বপ্ন আর সমৃদ্ধির গান। উপকূলের বুকে আঁচড়ে পড়ে আইলা-সিডর, মহাসেন-নার্গিস এবং জনপদের ধমনি-শিরায় লবণাক্ততার বিষক্রিয়ায় বিপন্ন কৃষির স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে কৃষক ও প্রযুক্তি বিদরা।
উপকূলে উচ্চমূল্য ফসলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ, নিবিড় চিংড়ি চাষ, সুন্দরবন সুরক্ষা, ঘেরের পাড়ে নিবিড় সবজি চাষ অব্যাহত থাকলে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের কৃষি জিডিপি’র পরিমান ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে সংশ্লিষ্টরা। উপকূলীয় ১৯ জেলার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল বা খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চল। রপ্তানিমুখী চিংড়ি শিল্প, বৈচিত্র্যময় কৃষি ও বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জন্য এই অঞ্চল অধিক গুরুত্ব বহন করে।
তথ্য-উপাত্ত আর সরেজমিনে কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায় সবুজ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব, প্রযুক্তি বিপ্লবের ছোঁয়াতে উপকূলের কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে উপকূলের তাপমাত্রাও বেড়েছে, এলোমেলো হয়েছে বৃষ্টিপাত। সেই সঙ্গে বেড়েছে বন্যা, খরা, সাইক্লোন, জলাবদ্ধতা। লবণাক্ততার তীব্রতা ও বিস্তৃতি দুটোই বেড়েছে উপকূলে; ফারাক্কার প্রভাবে নেতিয়ে পড়ছে নদীর প্রবাহ। জোয়ারে লবণ জলের বিস্তৃতি ঘটেছে বহুদূর। বেড়েছে সুপেয় পানির দুষ্প্রাপ্যতা।
গবেষণায় দেখা গেছে এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করে উপকূলের কৃষকরা লবণাক্ততার আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ করে শুকনো মৌসুমে বোরো ধান, ডাল, তৈল, ভুট্টা, আলু ও সবজি ফসলের আবাদে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। ১৯৯১ সালের ৩০ শতাংশ পতিত জমি ২০১৮ সালে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২ শতাংশে। বোরো ধান ও নন-রাইস ফসলের আবাদ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে খুলনা অঞ্চলে। এই সময়ে ভূ-পৃষ্টস্থ ও ভূগর্ভস্থ সেচে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনা অঞ্চলে গত তিন দশক (১৯৯১-২০১৮) আমন ধানের চাষ উলেখযোগ্য ভাবে কমে গেছে। বর্ষা মৌসুমে আমন ধান চাষ কমার প্রধান কারণ ক্রপিং সিস্টেমের পরিবর্তন। আমনের জমিতে কৃষক গলদা ঘের করছে। গবেষণার বিশেষ দৃষ্টি ছিল শুকনো মৌসুমে ফসলের কী অবস্থা।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, হাইড্রলজিস্ট, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী সবাই বলেছে উপকূলে সেচনির্ভর বোরো ধানের আবাদ কৃষি ও পরিবেশবান্ধব নয়। অথচ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জেলায় (খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট) গত বছর বোরো ধানের আবাদ হয়েছে প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে। দেশজ মোট হাইব্রিড ধানের আবাদের (১৫ লাখ হেক্টর) প্রায় ৮% হচ্ছে বৃহত্তর খুলনা জেলায়। কৃষকের ভাষ্য অনুযায়ী হাইব্রিড ধান লবণাক্ততা সহিষ্ণু। অত্যন্ত কম সেচ চাহিদার তৈলবীজ, ডাল, তরমুজ, ভুট্টা, আলু, সবজি চাষের আবাদ বৃদ্ধি নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। ১৯৯১ সালে নন-রাইস ফসলের আবাদ ছিল ৬০ হাজার হেক্টর, ২০২০ সালে প্রায় এক লাখ হেক্টর। দেশজ মোট তরমুজ আবাদের (১২ হাজার হেক্টর) ৮০ শতাংশ উপকূলে (বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম) হয়; শুধু খুলনা অঞ্চলে ৪০ শতাংশ তরমুজের চাষ হচ্ছে। দেশের ৪০ শতাংশ তিল চাষ হচ্ছে উপকূলে। চিংড়ি ঘেরের পাড়ের সবজি ও ফল চাষ ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষির মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।
গত এক দশকে উপকূলে বাগদা চাষ কমছে, অপরদিকে মিষ্টি পানির গলদা বেড়েছে উলেখযোগ্য ভাবে। ২০১০ সালের ২.১৩ লাখ হেক্টর বাগদা চাষ ২০২০ সালে কমে হয়েছে ১.৮৪ লাখ হেক্টর। অপরপক্ষে ২০১০ সালের ৪৩ হাজার হেক্টরের গলদা বেড়ে ২০২০ সালে হয়েছে ৭৩ হাজার হেক্টর। গলদা চাষের সঙ্গে শুকনো মৌসুমে বোরো ধান ও বছরব্যাপী সবজি এই ক্রপিং সিস্টেমকে আরও টেকসই ও লাভজনক করেছে। দুর্বল বাজার ব্যবস্থা, ভরা মৌসুমে ফসলের দাম পড়ে যাওয়া ও কৃষি ঋণ পেতে ভোগান্তির কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে কৃষকরা।
বাংলাদেশের মোট ৪৬ বিলিয়ন ডলারের কৃষি জিডিপি’র (ফসল, মাছ, বনজ সম্পদ, প্রাণিসম্পদ) ৫ শতাংশ (২.৩ বিলিয়ন ডলার) আসছে খুলনা অঞ্চল থেকে যা অন্য যে কোন নিবিড় কৃষির জেলা (বগুড়া, যশোর, কুমিলা, রংপুর) থেকে বেশি। পরিবর্তিত জলবায়ু, লবণাক্ততা ও বাজার ঝুঁকি মোকাবিলা, নদী-নালা খনন, আধুনিক সেচ নালা, সেচ স্কিম, কমিউনিটি ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা, স্লুইচ গেট মেরামতের মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির দক্ষ ব্যবহার বৃদ্ধি করা দরকার। প্রযুক্তি, পরিকল্পনা, বাজেট, আর কৃষকের ঘাম-শ্রমের সমন্বয় করতে পারলে উপকূলীয় বাংলার জোয়ার-ভাটার কৃষি হবে বিশ্বের রোল মডেল।