সব জল্পনা-কল্পনা শেষে শুরু হলো বইয়ের উৎসব অমর একুশে বইমেলা ২০২২। মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসাবে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি এ বইমেলার শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো করোনাকালের আরেকটি বইমেলা। আর প্রধানমন্ত্রীর ‘১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন পর্যন্ত মেলার সময় বাড়ানো যেতে পারে’ মন্তব্য হাসি ফুটিয়েছে প্রকাশকদের ঠোঁটে। প্রথম দিনের মেলায় অনেকে স্টল চালু করতে না পারলেও মানুষের সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো।
বাংলা একাডেমির মঞ্চে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরের ধারার শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং ভাষার গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। শুরুতেই মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর। প্রকাশক প্রতিনিধি হিসাবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন।
প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সাম্প্রতিক করোনা মহামারির কারণে গত বছর এবং এ বছর অমর একুশে বইমেলা নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আমরা করোনা এবং অন্যান্য অসুস্থতায় বাংলা একাডেমির তিনজন সভাপতি-জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান এবং মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে হারিয়েছি। তাদের সবাইকে আমরা যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, তেমনই একুশে বইমেলায় আগত সবাইকে নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে অনুরোধ করছি।
কেএম খালিদ এমপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছা এবং আন্তরিকতায় একটু বিলম্বে হলেও এবারের একুশের বইমেলা আজ শুরু হচ্ছে। আমরা আশা করি, সংস্কৃতিক্ষেত্রে সরকারের অব্যাহত প্রণোদনায় বইমেলাসহ সব জ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ড নতুন প্রজন্মকে মননশীল করে গড়ে তুলবে।
সভাপতির ভাষণে সেলিনা হোসেন বলেন, জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু যেমন বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিকায়ন সম্ভব করেছেন, তেমনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিলাভের মাধ্যমে বাঙালিকে বিশ্বদরবারে নতুন সাংস্কৃতিক উচ্চতায় উন্নীত করেছে।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, অর্ধশতাব্দী আগে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশের অনুষ্ঠানমালা উদ্বোধন করেছিলেন। আজ তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অমর একুশের বইমেলা শুভ উদ্বোধন করছেন-এটা আমাদের জন্য পরম আনন্দের বিষয়।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ প্রদান:
বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ প্রদান করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন-কবিতায় আসাদ মান্নান ও বিমল গুহ, কথাসাহিত্যে ঝর্না রহমান ও বিশ্বজিৎ চৌধুরী, প্রবন্ধ/গবেষণায় হোসেনউদ্দীন হোসেন, অনুবাদে আমিনুর রহমান ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, নাটকে সাধনা আহমেদ, শিশুসাহিত্যে রফিকুর রশীদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় পান্না কায়সার, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় হারুন-অর-রশিদ, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে শুভাগত চৌধুরী, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনিতে সুফিয়া খাতুন ও হায়দার আকবর খান রনো, ফোকলোরে আমিনুর রহমান সুলতান। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং অনুপস্থিত তিনজন লেখকের প্রতিনিধির হাতে তিন লাখ টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র তুলে দেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ এমপি একুশে বইমেলায় বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
শেষ হয়নি অনেক প্যাভিলিয়ন, স্টল নির্মাণকাজ:
এদিকে মেলার প্রথম দিন সরেজমিন বইমেলা ঘুরে দেখা যায়, অনেক বড় বড় প্রকাশনা তাদের প্যাভিলিয়ন ও স্টলের কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি। তবে মেলায় প্রথম দিনেই প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটেছে। প্রতিটি প্রবেশমুখেই আগত দর্শনার্থীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তল্লাসি করে মেলায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে দর্শনার্থীদের। প্রবেশমুখেই সবার হাত স্যানিটাইজও করানো হচ্ছে। মাস্ক ছাড়া কাউকেই মেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু মেলার মাঠে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, চলতে থাকা স্টল নির্মাণকাজ বিরক্তি ধরিয়েছে অনেকের। খোদ বাংলা একাডেমির স্টলগুলোর নির্মাণকাজও শেষ হয়নি। মেলা মাঠের রাস্তায় ইট বসানোর কাজও শেষ হয়নি।
মেলার সময় বৃদ্ধির বক্তব্যে প্রকাশকদের ঠোঁটে হাসি:
এদিকে ১৭ মার্চ পর্যন্ত মেলার সময় বৃদ্ধির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য হাসি ফুটিয়েছে প্রকাশকদের ঠোঁটে। বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির রাজধানী শাখার সভাপতি ও অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, জাতির পিতার কন্যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে বইবান্ধব ও প্রকাশকবান্ধব, সেটি আজ তার বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। গত মেলার ক্ষতি ও করোনাকালের ক্ষতি প্রকাশকরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। জাতির পিতার জন্মদিন ১৭ মার্চ পর্যন্ত বইমেলার সময় বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে আমরা সাধুবাদ জানাই। এটি কার্যকরের মধ্য দিয়ে মেলা যেমন সফল হবে, ঠিক একইভাবে প্রকাশকরা করোনকালের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবেন।
মেলায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি:
মেলার শুরুর দিনই বইমেলায় এসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখার পাশাপাশি কিনেন পছন্দের নানা বইও। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বইমেলা আমাদের প্রণের মেলা। মেলায় এসে খুব ভালো লাগছে। করোনার দুর্ষহ একটা আবহ আমরা দেড় বছর থেকে পার করছি। তবে জীবনের অন্যদিকগুলো সব স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে বইমেলাও।
নতুন বই:
মেলার শুরুর দিনেই বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে শতাধিক নতুন বই প্রকাশ হয়েছে। তবে বাংলা একাডেমির তথ্যসেবা কার্যক্রম এখনো চালু না হওয়ায় সত্যিকার অর্থেই এদিন কত বই প্রকাশ হয়েছে, এর তথ্য জানা যায়নি। নতুন প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে প্রথমা থেকে প্রকাশিত ড. আকবর আলি খানের ‘পুরানো সেই দিনের কথা’, আনিসুল হকের উপন্যাস ‘রক্তে আঁকা ভোর’, শোভা প্রকাশ থেকে তারেক শামসুর রেহমানের ‘করোনা পরবর্তী বিশ্বরাজনীতি’, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত জালাল ফিরোজের ‘অমর একুশে বইমেলার ইতিহাস’ অন্যতম।
বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) অমর একুশে বইমেলা শুরু হবে বেলা ২টায়। চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত।