সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বাসিন্দা বৃদ্ধা জয়তুন বেগম। ৩০ বছর আগে স্বামী বারিক মোল্লা তাকে ছেড়ে চলে যান। নদীতে জাল টেনে ও দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালিয়ে একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেন। তবে মেয়ের সংসারটিও টেকেনি। গত ৪ বছর আগে জরায়ু রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন বৃদ্ধা জয়তুন।
অভাবের সংসারে চিকিৎসা করাতে পারেননি। স্থানীয় চিকিৎসকরা অপারেশনের জন্য দাবি করেন ৩০ হাজার টাকা। সেটিও জোগাড় করতে পারেননি তিনি। অচল হয়ে পড়েছিলেন ঘরে। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ও জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমানের আর্থিক সহযোগিতায় টানা ১১ দিনের চিকিৎসা শেষে শুক্রবার (১৮ মার্চ) সকাল ১০টার দিকে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন এই বৃদ্ধা।
বৃদ্ধা জয়তুন বেগমের স্বামীর বাড়ি ছিল পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি গ্রামে। তবে এখন তিনি ওই ইউনিয়নের গড়কুমারপুর গ্রামে বৃদ্ধার বড় ভাই জিল্লুর রহমান বিশ্বাসের বাড়ির কোণে ঝুপড়ি ঘরে থাকেন। নিজস্ব কোনো জমি নেই এই বৃদ্ধার। সঙ্গে রয়েছেন একমাত্র মেয়ে শাহিনা খাতুন ও দুই নাতনি।
অসহায় বৃদ্ধার ঘটনাটি নজরে আসে সেবামূলক সংগঠন হিউম্যানিটি ফাস্টের পরিচালক কলেজ প্রভাষক ইদ্রিস আলীর। ঘটনাটি তুলে ধরেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। এরপরই বৃদ্ধার পাশে দাঁড়ান সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার এবং সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ।
হিউম্যানিটি ফাস্টের পরিচালক সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক ইদ্রিস আলী জানান, বৃদ্ধা জয়তুন বেগম দিনমজুরি ও ভিক্ষাবৃত্তি করে সংসার চালাচ্ছিলেন। জরায়ু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর অভাবের তাড়নায় চিকিৎসা করতে পারছিলেন না। অবশেষে আমরা উদ্যোগ নিলে জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান এবং পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান সকল চিকিৎসা ব্যয় বহন করেন।
তিনি বলেন, ১১ দিন আগে বৃদ্ধা জয়তুন বেগমকে সাতক্ষীরা শহরের ক্রিস্টাল ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অপারেশন করে জরায়ু কেটে বাদ দিয়েছেন চিকিৎসক। এখন তিনি সুস্থ হয়েছেন। শুক্রবার সকালে বৃদ্ধাকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারের দেওয়া ২৫ হাজার টাকা এবং জেলা ও দায়রা জজের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধার চিকিৎসার পেছনে ২২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বাকি ওই ৮ হাজার টাকা বৃদ্ধার সংসারের খরচ হিসেবে দেওয়া হবে।
জয়তুন বেগমের মেয়ে শাহিনা খাতুন বলেন, মা এখন সুস্থ হয়েছে। আমরা বাড়িতে ফিরে এসেছি। চিকিৎসা কীভাবে হয়েছে কত টাকা খরচ হয়েছে এসব আমরা জানি না। ইদ্রিস স্যার সব টাকা খরচ করেছেন।
জয়তুন বেগম বলেন, ৩০ বছর আগে স্বামী আমাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই বসবাস করে। আমি নদীতে জাল টেনে ও দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতাম। চার বছর আগে থেকে হঠাৎ জরায়ু রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। ভারী কাজ করা, লোনা পানিতে জাল টানা এসব কারণে এমনটা হয়েছে বলে আমার মনে হয়। অভাবের কারণে চিকিৎসা করতে পারছিলাম না। অবশেষে চিকিৎসা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমার থাকার ঘর নেই। মেয়েসহ দুই নাতনিকে নিয়ে যেখানে থাকি সেখানে থাকা যায় না। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। আপনারা আমার একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন। তবে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে একটু ভালোভাবে থাকতে পারবো।
ওই বৃদ্ধার অপারেশন করেছেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুন্নাহার শিউলী। তিনি বলেন, লোনা পানির সঙ্গে জরায়ু নষ্ট হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। এই বৃদ্ধা যখন সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। তারপরই তিনি ভারী কাজগুলো করেছেন। সে কারণে তার জরায়ু দুর্বল ও নিচে নেমে এসেছে। এর প্রতিক্রিয়া হঠাৎ শুরু হয় না, ধীরে ধীরে হয়। যখন নারীদের বয়স বেশী হয়, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখনই মূলত প্রভাব পড়তে শুরু করে শরীরে।
তিনি বলেন, নারীদের যখন জরায়ু নিচে নেমে আসে তখনই যদি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় তবে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে অনেকেই গোপন করে একেবারেই শেষ সময়ে চিকিৎসকের কাছে আসেন। তখন কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। জয়তুন বেগমের ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটেছে। তার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে। এখন তিনি সুস্থ আছেন।