কুষ্টিয়ায় ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে বসেছে ভবের হাট
বাউলসম্রাট ফকির লালন সাঁইজির ১৩৩তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে আজ পহেলা কার্তিক ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে শুরু হচ্ছে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসব। এ উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে বসেছে ভবের হাট।
তিন দিনের এ উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। লালনের মাজার প্রাঙ্গণে গুরুকার্যের মধ্য দিয়ে শুরু হবে বাউল সাধুগুরুদের সাধুসঙ্গের আনুষ্ঠানিকতা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং জেলা প্রশাসন কুষ্টিয়ার আয়োজনে মূল মঞ্চের আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে আলোচনা সভার উদ্বোধন করবেন।
ইতোমধ্যেই মনের টানে সাঁইজির ধামে চলে এসেছেন বাউল সাধু ও ভক্তরা। ছোট ছোট দলে বসে লালনের গানে গানে প্রচার করছেন তার মানবদর্শন। এবারের উৎসবে দাবি উঠেছে উৎসবকে চেতনা ও দর্শননির্ভর করতে বাণিজ্যের জায়গা কমিয়ে বাউল সাধুদের বসার জায়গা বাড়ানোর। এবারে বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই জমজমাট এই আখড়াবাড়ি।
১২৯৭ বঙ্গাব্দের পহেলা কার্তিককে ফকির লালন সাঁইজির দেহত্যাগের দিন ধরে এভাবেই এ উৎসব চলে আসছে। কোনো দাওয়াত বা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই দিনক্ষণ, তিথি ঠিক রেখে এ উৎসব উপলক্ষে সাঁইজির বারামখানায় চলে আসেন দেশ-বিদেশের সাধু, বাউল ও ভক্ত-অনুসারীরা।
সিলেট থেকে এসেছেন ফকির রফেল সাঁই। ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে পা রেখেই লালন সাঁইয়ের মাজারের দিকে অবনত মস্তকে ভক্তি জানিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দর্শন করলেন সাঁইজির বারামখানা। রফেল সাঁই বললেন, আমরা মানবধর্মে বিশ্বাসী, যে ধর্মে মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ নেই। তাই তো প্রতিবছর এই দিনে শত বাধা-বিপত্তিকে পাশে ফেলে আমরা এখানে ছুটে আসি। এখানে আমাদের সাঁইজি ঘুমিয়ে আছেন। তার দর্শন না পেলে আমাদের মন ছটফট করে। এখানে এসে যদি আমরা না খেয়েও থাকি, তার পরও হৃদয়ে পরম শান্তি অনুভব করি।
লালন গবেষক ফকির হৃদয় সাঁই বলেন, এখন শুধু ফকির লালন সাঁইজি নয়, তার রেখে যাওয়া মানবধর্মের যেসব বাণী, সেগুলো সারা বিশ্বের গবেষণার বিষয়। আজ থেকে ১৩৩ বছর আগে সাঁইজি যা বলে গিয়েছেন, তার তিরোধানের এত বছর পরও তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে গবেষণা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাঁইজির মানবধর্ম এবং তার বাণী যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা বা প্রচার করা যায়, তা হলে বর্তমান সমাজে এই হানাহানি থাকত না। থাকত শুধু মানবতার জয়জয়কার।
ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণোৎসবে একদিকে লালন মাজার প্রাঙ্গণে বসেছে বাউল সাধুদের ভাববিনিময়ের আসর। অন্যদিকে কালি নদীর বিশাল মাঠজুড়ে আয়োজন করা হয়েছে গ্রামীণ মেলার। যেখান প্রতিদিন লাখ লাখ বাউল-সাধক, অনুসারী এবং দর্শনার্থী ভিড় জমাবেন। আখড়াবাড়ি ঘিরে এখন গানে গানে সারাক্ষণ চলছে লালনের জাতপাতহীন, মানবতাবাদী, অহিংস দর্শনের প্রচার।
বিশাল এই আয়োজনকে সার্থক করতে নেয়া হয়েছে তিনস্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা। ছেঁউড়িয়ার প্রতিটি মোড় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি থাকছে সাদাপোশাকের পুলিশ। সেই সঙ্গে থাকছে র্যাবের টহল। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। মেলা এলাকায় বসানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি এহতেশাম রেজা বলেন, ‘বিশাল আয়োজনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তার পরও চলছে কোনো ভুলত্রুটি আছে কি না, তা পরখ করার কাজ। পুরো ছেঁউড়িয়া এলাকাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বসানো হয়েছে মেটাল ডিটেক্টর গেট। বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশা করা যায়, অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশ এবারের উৎসবটি আমরা পালন করতে পারব।
এই লালন স্মরণোৎসব চলবে আগামী ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত।