ডিমওয়ালা ইলিশ রক্ষায় সরকারের ঘোষিত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। সোমবার (২৫ অক্টোবর) মধ্যরাত থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরপরই ইলিশ ধরতে নেমে পড়েন জেলেরা। কিন্তু ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে এখনো জেলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ডিমসহ ইলিশ ধরছে। জেলেরা জানান, এদের বেশির ভাগই বড় ডিমওয়ালা মা।
জেলেরা জানান, তাদের জালে ধরা ডিমসহ মা ইলিশ তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ডিম ছাড়বে। কিন্তু ডিম ছাড়ার আগেই জেলেদের হাতে ধরা পড়ছে মা ইলিশ। প্রতিদিন তাদের জালে ধরা পড়া ইলিশের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ডিম পাড়ার ইলিশ। ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞার পর আর কোনো বছরে তাদের জালে আর কোনো ডিম ধরা পড়েনি। তাই ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
ক্ষুব্ধ হয়ে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার জেলে ও জেলেরা জানান, প্রতিবছর মা ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ভোলা ও তেঁতুলিয়ার কোনো জেলে, ব্যবসায়ী বা জেলেদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। এ বছরও একই মতামত ছাড়াই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ফিশ বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানীর দাবি, চলতি বছরের ১৭ অক্টোবর থেকে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে মা ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিমাণ অনেক বেশি হতো।
ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতলী মাছ ধরার ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকা ও ট্রলারে মেঘনা নদী থেকে ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। পরে তিনি ঘাটের গুদাম রক্ষকের কাছে ইলিশ বিক্রি করছিলেন। কিন্তু জেলেদের আনা ইলিশের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ডিমওয়ালা মা ইলিশ। অনেক মায়ের পেট থেকে ইলিশও ডিম পাড়ছে। জেলেরা ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা আশা করছেন মা ইলিশ তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ডিম পাড়বে। এমন দৃশ্য দেখে নদীতে ভবিষ্যৎ ইলিশ সংকট নিয়ে শঙ্কিত জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীরা।
ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও তুলাটুলি মেঘনা নদীর জেলে মো. লোকমান হোসেন মাঝি বলেন, বৃহস্পতিবার ভোর ৪টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তুলাতলী মেঘনা নদীতে ১১টি বড় ইলিশ ও ৮টি ঝাটকা পেয়েছি। ১১টি ইলিশের মধ্যে ডিম পাড়ে মাত্র ৩টি। বাকি ইলিশগুলোর পেট ডিমে ভরা।
তুলাটুলী গ্রামের বাসিন্দা ও মেঘনা নদীর জেলে মো. হানিফ মাঝি বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন সাইজের ৩০টি ইলিশ পেয়েছি। এর মধ্যে মাত্র চারটি ইলিশের ডিম ছাড়া হয়েছে। বাকি সবার পেটে ডিম ছিল। আমিও দুটি ইলিশ জাল ধরে ডিম পাড়া দেখেছি।
জেলে মোঃ আবুল কাশেম জানান, তিনি ৩৫ বছর ধরে মেঘনা নদীতে মাছ ধরছেন। প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে গিয়ে অনেক ডিম (নাশপাতি) ইলিশ পাই। তবে এ বছর তিন থেকে চার দিনে মাত্র পাঁচ আউন্স ইলিশ পেয়েছি।
জেলর মোঃ আমির হোসেন মাঝি বলেন, সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা প্রতিবছর সফল হলেও এ বছর নদীতে গিয়ে ডিমসহ মা ইলিশ বেশি পাচ্ছি। আর পাই ইলিশ খুব কম পাই। আমরা জেলেরা মনে করি ২২ দিনের অভিযান এ বছর ব্যর্থ হয়েছে।
তুলাতলী ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী মো. মঞ্জু ইসলাম বলেন, দেশের খুচরা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি বা রপ্তানি হওয়া ইলিশের বেশির ভাগই ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী থেকে ধরা হয়। মা ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারণে ভোলার কোনো মাছের গুদাম রক্ষক, ব্যবসায়ী বা জেলেদের মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয় না। সঠিক সময় নির্ধারণ না করায় এ বছর ইলিশ মৌসুমে নদীতে ইলিশের সংকট দেখা দিয়েছে। একই কারণে এ বছর সরকারের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও নদীতে গিয়ে প্রচুর মা ইলিশ পাচ্ছেন জেলেরা। নিষেধাজ্ঞার সময় নিয়ে জেলে ও জেলেদের মতামত জানতে পারলে এ বছর এমনটা হতো না।
বিশ্ব মৎস্য বাংলাদেশের মৎস্য বিজ্ঞানী ড. মোঃ জলিলুর রহমান জানান, মেঘনা নদীতে এ বছর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মা ইলিশের ডিম পাড়া হয়েছে। যা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। তবে ১৬ বা ১৭ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরার উপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে ইলিশের জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেত।
তবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, এ বছর মেঘনা নদীতে মা ইলিশ কত ডিম দিয়েছে তা নিয়ে গবেষণা চলছে। আমরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চূড়ান্ত পরিমাণ বলতে পারব।